নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকার বনানীর বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাসকারী আসমা আক্তার ওরফে জেসমিন জুই, যিনি নিজেকে মডেল ও সমাজসেবী হিসেবে পরিচিত করিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। 

তদন্তে জানা গেছে, আসমা আক্তার শুধু নিজেই নয়, তার পরিবারসহ একটি চক্র প্রতারণায় জড়িত। যে চক্রে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ান প্রবাসী ও সিডনি আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতাসহ আরো অনেকেই। যারা  মিলে বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের  সর্বস্বান্ত করার অভিযোগ উঠেছে।  যেখানে উঠে আসছে দেশের বৃহৎ একটি শিল্পগ্রুপের মালিকের পিএস’র নামও। 

এছাড়া সম্প্রতি মাদক কান্ডে দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নাট্যাভিনেত্রী ও মডেলকন্যার নাম উঠে এলেও। সেই চক্রের সাথে মডেল আসমা আক্তার ও তার পরিবারের নামও তদন্তে উঠে আসছে বলে জানা গেছে। 

তদন্তে জানা যায়, আসমা প্রথমে ফেসবুকে বন্ধুত্ব করেন, এরপর ভিডিও কলে ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতা চালান। সেই আলাপচারিতার ভিডিও সম্পাদনা করে ব্ল্যাকমেইল এবং দীর্ঘমেয়াদে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করেন।

আসমার অবাধ যাতায়াত রয়েছে নাইট ক্লাব, তারকা হোটেলের বার ও অভিজাত ক্লাবগুলোতে। ক্লাবে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মদ্যপান ও ঘনিষ্ঠ আলাপ চালিয়ে পরবর্তীতে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেন। সম্পর্ক গাঢ় হওয়ার দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে একসঙ্গে রাত কাটানোর প্রস্তাব দেন। রাজধানীর ফাইভ স্টার হোটেল বা বিদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা দেন। আর আসমা আক্তারের ফাঁদে পা দিলেই এর পর থেকে শুরু হয় তার পুরো চক্রের আসল খেলা। একের পর ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। আর প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিরা সামাজিক মর্যাদার ভয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে বাধ্য হয় আসমা আক্তারসহ তার পুরো চক্রকে। 

আলোচিত ব্যবসায়ীর পিএস’র সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক

আসমা আক্তার দেশের একজন আলোচিত ও বিতর্কিত ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত সহকারী (পি.এস.)-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এই ব্যবসায়ী দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য পরিচিত এবং তার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আসমা তার এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীর নাম ব্যবহার করে তিনি বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করেছেন। তাদের আস্থা অর্জনের পর, তিনি তাদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করতেন।

বিশ্বস্ত সূত্রের দাবি, আসমা ওই ব্যবসায়ীর সহকারীকে ব্যবহার করে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পেতেন। যেখানে থেকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী, এমপি ও সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেন তিনি। অনেক সময় তিনি এ ধরনের সম্পর্কের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং পরে তা ব্ল্যাকমেইলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন। 

এছাড়া, অস্ট্রেলিয়ার একজন প্রবাসী ব্যবসায়ীর সঙ্গেও তার গভীর সম্পর্ক ছিল। জানা গেছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি আওয়ামী লীগের ১ম সারির একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন তিনি। প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইল করে পাওয়া সব টাকা বিদেশে পাচারে করতো এমনি টাই তদন্তে উঠে আসছে। 

অভিযোগ রয়েছে, তিনি তাদের বনানীর ফ্ল্যাটে নিয়ে আসতেন এবং গোপনে ভিডিও ধারণ করতেন। পরে সেই ভিডিও ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করতেন।

সুবিধাবঞ্চিতদের সাহায্যের আড়ালে প্রতারণা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে আসমা আক্তার নিজেকে একজন সমাজসেবী হিসেবে প্রচার করে আসছেন। বিভিন্ন ইভেন্টে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য সাহায্যের কথা বলে তিনি দেশি-বিদেশি বহু মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। অভিযোগ উঠেছে, এসব অর্থের বড় একটি অংশ তিনি ব্যক্তিগত বিলাসিতায় ব্যবহার করেছেন। অনেকেই মনে করেন, সমাজসেবার আড়ালে আসমা মূলত ধনী ব্যক্তিদের টার্গেট করতেন।

বনানীর ঐ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আসমা আক্তারের জুই এর এসব অপকর্মের আশেপাশের লোকজন অনেকেই জানেন। এমনকি বিষয়টি এক প্রকার ওপেন সিক্রেট এবং বিষয়টি তাদের জন্য বিব্রতকর বলেই অনেকেই কথা বলতে চাননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আসমা আক্তারের এক প্রতিবেশি জানান, প্রথম প্রথম দেখতাম অনেক বড় বড় লোকেরা আসতো। আমরা এটা স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে দেখি এক এক সময় এক একজন আসতো তার ফ্ল্যাটে। 

কেন আসতো তারা, জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছুটা বিব্রতকর ভঙ্গিতে বলেন – বুঝেনিতো একা একটা মেয়ের বাসায় এক এক সময় এক এক পুরুষ কেনো যায়? এক পর্যায়ে তিনি বলেন, তার (আসমা আক্তার) এসব অপকর্মের বিষয় সম্পর্কে আমরা যেমন জানি আমাদের ছেলে মেয়েরাও জানে। এগুলো আমাদের জন্য বিব্রতকর। 

আসমা আক্তারের নামে আগেও প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, তিনি এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিলেন এবং তার কাছ থেকে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। সেই বিয়েও শেষ পর্যন্ত টিকেনি। বর্তমানে তার কোনো স্থায়ী আয়ের উৎস নেই, তবুও তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন।

কথিত মডেল জেসমিন জুঁই’র উথান যেভাবে

মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আসমা আক্তার জুঁই তার মডেল জগতের ক্যারিয়ার শুরু করেন ত্রয়ি গ্রুমিং একাডেমির মাধ্যমে। মডেলিং জগত থেকে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের হাত ধরে ধীরে ধীরে অভিনয় জগতেও উত্থান ঘটে তার। জানা যায়, নৈতিক অধঃপতনের কারণে তাকে একাডেমি থেকে একসময় বহিস্কার করেন ত্রয়ির প্রধান নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা আলি ফজল নিকোলাস। 

শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় ওয়েব সিরিজের পরিচালনার কাজও করেছেন কথিত মডেল জুঁই। বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেছে, এসব ওয়েব সিরিজ বানাতে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবীদদের প্রতারনার জালে ফাঁসিয়ে বড় অংকের টাকা নিয়েছিলো আসমা আক্তার। 

বর্তমানে অবিবাহিত আসমা আক্তার থাকেন নিজের মা বাবার সাথে। তারা দুই বোন ও এক ভাই। জানা গেছে, নিজের পরিবারের লোকজনও আসমা আক্তারের এসব অপকর্ম সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন। তবে আসমা আক্তার পরিবারের সবচেয়ে বেশি উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় তারাও চুপ করে থাকেন। 

সর্বশেষ, এই মডেলের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন প্রতারণার অভিযোগ করেছেন। যদিও তাদের সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে নামগুলো প্রকাশ করা যাচ্ছেনা তবে, এসব অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। আসমার ফ্ল্যাটে সন্দেহজনক কার্যক্রমের বিষয়ে স্থানীয়রাও অনেক তথ্য দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতোমধ্যে তার বিভিন্ন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে এবং অর্থের উৎস সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে।

অভিযোগের সত্যতা জানতে, কথিত মডেল আসমা আক্তার জুই এর বনানীর সেই ফ্ল্যাটে গেলে সেটি বন্ধ দেখা যায়। এমনকি তার মোবাইলে একাধিক বার কল দিলেও তুনি কল রিসিভ করেন নি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You May Also Like

মাদক কান্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে তারকাদের নাম, ধরাছোঁয়ার বাইরে অনেকেই

ডেস্ক নিউজ: দেশের শোবিজ অঙ্গনে মাদকসংশ্লিষ্টতা নিয়ে নতুন করে আলোচনার ঝড় উঠেছে।…

এস আলম গ্রুপের আট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ, অর্থ পাচারের অভিযোগে দুদকের চিঠি

ডেস্ক নিউজ: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এস আলম গ্রুপের বন্ধ ঘোষণা করা…

জামায়াতকে ক্ষমতায় দিলে দুর্নীতি বন্ধ হবে: সেলিম উদ্দিন

ডেস্ক নিউজ: জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের…

শেখ পরিবারের দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অনলাইন ডেস্ক: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং…