বিশেষ প্রতিবেদন: সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে যে কয়েকটি বৃহৎ আকারের কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এসেছে, তার মধ্যে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনিয়মগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ লোপাট, ভ্যাট ফাঁকি এবং বিদেশে অর্থ পাচারের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এই ব্যাপক অনিয়মের চক্রে মূল ব্যক্তিদের মধ্যে কেবল গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের নাম বারবার উঠে এলেও, অনুসন্ধানে জানা গেছে অধিকাংশ আর্থিক কেলেঙ্কারির মুলহোতা ছিলেন সাইফুল আলম মাসুদের মেয়ের জামাই বেলাল আহমেদ এবং তার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) আকিজ উদ্দিন।

সম্প্রতি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে এক নারী ব্যবসায়ীর মাধ্যমে প্রায় ৮০ কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি উঠে এলে জানা যায় – এই আর্থিক কেলেঙ্কারির সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিন। যেখান থেকে বিশাল অংকের একটি ভাগ পেয়েছেন মেয়ের জামাই বেলাল আহমেদ। এমনকি এই বিষয় নিয়ে সাইফুল আলম মাসুদের সাথে মেয়েরা জামাই বেলাল ও পিএস আকিজের সাথে বেশ উচ্চবাক্যও হয়েছে বলে গোপন একটি সুত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, বর্তমানে এস আলম গ্রুপের অনেক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদকে কোনটাসা করে রেখেছে বেলাল ও আকিজ। এই দুইজনই এখন অলিখিতভাবে এস আলমের হর্তাকর্তা হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে, মা মারা যাওয়ার পর থেকে এবং মায়ের জানাযায় উপস্থিত থাকতে না পারার কারণে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছেন সাইফুল আলম মাসুদ – যে কারণে কোম্পানির অনেক কিছুই ছেড়ে দিয়েছেন মেয়ের জামাই বেলাল ও পিএস আকিজের উপর। আর সে সুযোগেই তারা যেমন খুশি তেমন করে বিশাল এই শিল্পগ্রুপটিকে পরিচালনা করছে এবং সুবিধা মতো অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই দুইজনের কারণে ইতিমধ্যে নিজ ভাই আবদুস সামাদ লাবুর সাথেও দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে সাইফুল আলম মাসুদের।

স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার: শ্বশুরের প্রভাব খাটিয়ে হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি

এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদের জামাতা বেলাল আহমেদ এই বৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পারিবারিক সম্পর্ককে ব্যবহার করে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন এবং নিজ শ্বশুরের অগোছরে ঘটিয়েছেন নানান আর্থিক অনিয়ম। এমনকি একসময় বাগিয়ে নিয়েছিলেন এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদও। ২০১০ সালে সাইফুল আলম মাসুদের মেয়ের সঙ্গে বেলাল আহমেদের বিয়ের পর থেকেই ব্যাংকিং খাতে তার পারিবারিক আধিপত্য শুরু হয় । এই পারিবারিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়েই বেলাল আহমেদ তার মালিকানাধীন ইউনিটেক্স গ্রুপের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ হাতিয়ে নিয়েছেন।

ইসলামী ব্যাংক থেকে ইউনিটেক্স গ্রুপ ৩,৭৪৫ কোটি টাকা ঋণ লোপাট করেছে । এই ঋণ বিতরণে গুরুতর অনিয়মের চিত্র পাওয়া যায়। বিভিন্ন গণমাধ্যম সুত্রে জানা যায়, ইউনিটেক্স স্টিল নামের একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ৮১৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়, অথচ সেখানে কোনো কারখানাই স্থাপন করা হয়নি। এই ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তির মূল্য ছিল মাত্র ২৮ কোটি টাকা, যা ঋণের তুলনায় অতি নগণ্য । একই ধরনের অনিয়ম গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, যেখানে ১,১৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদনের বিপরীতে জামানত ছিল মাত্র ৪ কোটি টাকা । ব্যাংকের কর্মকর্তারা সরাসরি স্বীকার করেছেন যে, শ্বশুরের প্রভাব খাটিয়ে বেলাল আহমেদ এই ঋণ হাতিয়ে নিয়েছেন এবং ঋণ বিতরণে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনাগুলো একটি সুপরিকল্পিত এবং পদ্ধতিগত জালিয়াতির ইঙ্গিত দেয়। এসব ভুয়া ঋণের মুল উদ্দেশ্যই ছিলো ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নেওয়া, এগুলো কোনো উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের জন্য ছিল না। এর ফলে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে, যা ব্যাংকটিকে দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলেছে ।

পিএস আকিজ উদ্দিনের অপকর্ম: এস আলমের ব্যাংকগুলোতে অলিখিত ‘চেয়ারম্যান’

এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) আকিজ উদ্দিনের বিরুদ্ধেও গুরুতর আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, যা তার অস্বাভাবিক ক্ষমতা এবং প্রভাবের একটি চিত্র তুলে ধরে। তার কর্মজীবনের গতিপথ ছিল অত্যন্ত অস্বাভাবিক। ২০০৯ সালে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার (ক্যাশ) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে, মাত্র ১৪ বছরের মধ্যে তিনি দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) পদে উন্নীত হন। ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এত দ্রুত ডিএমডি পদে পদোন্নতি এর আগে কেউ পায়নি । এই অস্বাভাবিক উত্থান প্রমাণ করে যে, তার পদোন্নতি পেশাদার যোগ্যতা বা দক্ষতার ভিত্তিতে হয়নি, বরং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কারণে হয়েছে। তিনি সাইফুল আলমের ‘বিকল্প চেয়ারম্যান’ হিসেবে কাজ করতেন এবং ব্যাংকে নিয়োগ, কেনাকাটা ও ঋণ বিতরণের মতো সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন।

দুদক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল আলম এবং তার পিএস আকিজ উদ্দিনসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে ৮০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছে । এই মামলার মূল অভিযোগ হলো, লা-অ্যারিস্টোক্রেসি নামে একটি রেস্তোরাঁর মালিক নাজমে নওরোজের মাধ্যমে ঋণসীমা (২ কোটি টাকা) লঙ্ঘন করে ৭০ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়, যার একটি বড় অংশ পেয়েছিলেন সাইফুল আলম মাসুদের মেয়ের জামাই বেলাল ও পিএস আকিজ উদ্দিন । এই ঘটনাটি আকিজ উদ্দিনের ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি বড় দৃষ্টান্ত। তিনি নাজমে নওরোজের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুযোগে এই অবৈধ লেনদেনের পথ খুলে দিয়েছেন । দুদক বলছে, এই ধরনের লেনদেন বেনামি ঋণ বিতরণের একটি নমুনা, যা ব্যাংকিং খাতের ঋণ ব্যবস্থাপনায় একটি বড় ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ করে।

এছাড়া, আকিজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তার মালিকানাধীন ‘গোল্ডেন স্টার’ ও ‘টপ টেন ট্রেডিং হাউজ’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮৮৯ কোটি টাকা বেনামি ঋণ উত্তোলনের চেষ্টা করা হয়েছিল । অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি অবৈধভাবে অর্জিত অর্থকে বৈধ আর্থিক প্রবাহের মধ্যে পুনঃপ্রবেশ করিয়ে ইসলামী ব্যাংকের বিদেশি কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনে এস আলম গ্রুপের বেনামি মালিকানা নিশ্চিত করতেন ।

এই বিশাল দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর নড়েচড়ে বসেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করেছে। একই সঙ্গে, বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে সাজিয়েছে, যা এই কেলেঙ্কারির ভয়াবহতা প্রমাণ করে। ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) এস আলমের বিরুদ্ধে ১.১৩ লাখ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগের তদন্ত করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You May Also Like

বনানীর বিতর্কিত মডেল আসমার প্রতারণা: জড়াল ব্যবসায়ীর পিএস-এর নাম

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকার বনানীর বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাসকারী আসমা আক্তার ওরফে জেসমিন জুই,…

মাদক কান্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে তারকাদের নাম, ধরাছোঁয়ার বাইরে অনেকেই

ডেস্ক নিউজ: দেশের শোবিজ অঙ্গনে মাদকসংশ্লিষ্টতা নিয়ে নতুন করে আলোচনার ঝড় উঠেছে।…

শেখ পরিবারের দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অনলাইন ডেস্ক: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং…

এস আলম গ্রুপের আট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ, অর্থ পাচারের অভিযোগে দুদকের চিঠি

ডেস্ক নিউজ: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এস আলম গ্রুপের বন্ধ ঘোষণা করা…